মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ
বড় বড় করে লাল অক্ষরে লেখা ‘এখানে খাটি মানুষের মাংস পাওয়া যায়’।
বড় বড় করে লাল অক্ষরে লেখা ‘এখানে খাটি মানুষের মাংস পাওয়া যায়’। হারুন আমাকে দেখিয়ে বলে, দেখ ‘খাঁটি’ শব্দে চন্দ্রবিন্দু বসায়নি। তাছাড়া, মানুষ খাঁটি হয় কি করে, মাংস হতে পারে! নিশ্চিত ভেজাল মাংস রাঁধে! হারুন ক’বছর আগে একটা পত্রিকা অফিসে প্রুফ দেখার কাজ করত, সেই থেকে ভুল বানান দেখলে এভাবে চট করে একটা সিদ্ধান্তে চলে আসে। একবার ছোটবোনের বিয়ে ঠিক হলো, ছেলের নাম আবদুচ ছলিম। নামের বানান দেখার পর বিয়েটা ভেঙে দিল। বলল, যার নামের বানানে গণ্ডগোল, সে ছেলে সুবিধার হতে পারে না।
মানুষের মাংসের চাহিদা বাড়ার পর রাজধানীর এই এলিট অঞ্চলে আরও কিছু হোটেলে মানুষের মাংস বিক্রি করা হয়, তাই কয়েকটি হোটেলের ব্যানারে মানুষের খাঁটি মাংস পাওয়া যায় বলে দাবি করা হয়েছে। কদিন আগে একটা দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ‘মানুষের নামে কুকুকের মাংস!’ শিরোনামে। এরপর হোটেলগুলো বুঝেসুঝে নামকরণ করেছে। একটা হোটেলের নাম যেমন, ‘ওল্ড মানুষের মাংস রেস্তোরাঁ’। আরেকটার নাম ‘নিউ মানুষের মাংস রেস্টুরেন্ট’। বিপরীতে চোখে পড়ে ‘অরিজিনাল মানুষের মাংস ভোজ’ শীর্ষক হোটেলটি। কোনো এলাকায় একটি খাবার বিখ্যাত হয়ে গেলে অনেকে সেই বিখ্যাত খাবারের প্রকৃত মালিক বলে এভাবে দাবি তোলে।
মানুষের বলে কুকুরের মাংস খাইয়ে দেবে না-তো? হারুন বলে।
এই কারণেই তো হোটেলের নাম জেনে এসেছি। ওকে আস্বস্ত করি।
আমরা, মানে আমি আর হারুন ‘Meet Human Meat’ হোটেলে এসেছি বন্ধু ইমরোজের পরামর্শে। ইমরোজ এনজিওর বড়ো কর্মকর্তা, ডোনারদের নিয়ে প্রায়ই এ ধরনের পশ হোটেলগুলোতে বসতে হয়। ও জানে সুস্বাদু মানুষের মাংস কোথায় পাওয়া যায়। শুধু এই কারণে নয়, ইমরোজ দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো কোন জেলায় কোনটা অথেনটিক বলে দিতে পারে। শুধু খাওয়ার জন্য কোনো মানুষের জন্ম হয় কিনা জানি না, ইমরোজের হয়েছে বলে আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। সকালেই ইমরোজকে ফোন দিই। ও জানায় ‘মিট হিউম্যান মিট’ খুব নাম করা না হলেও মানুষের মাংসটা রাঁধে ভালো। বিশেষ করে ফ্রাইটা দারুণ হয় এখানে। রেজালাটা ভালো করে ‘ওল্ড মানুষের মাংস রেস্তোরাঁ’। আমি রেজালা পছন্দ করলেও হারুন বলল ফ্রাই খাবে। পোড়া মানুষের কথা অনেক শুনেছে, দেখেছেও—যেহেতু বস্তি উচ্ছেদ নিয়ে কাজ করে; এবার স্বাদটা নিতে চায়। বিলটা হারুনই দেবে, তাই আমি আর রেজালার দিকে টানলাম না।
আমরা ‘মিট হিউম্যান মিট’-এ এলাম। হোটেলের মালিক এক সাবেক মন্ত্রী। দেয়ালে বড় করে তার ছবি টাঙানো। শরীরে সাদা থান প্যাচানো, হজের ছবি। ছবিটার নিচের টেবিলে আমরা বসেছি। এদিকে আলো ও মানুষের চাপ, দুটোই কম। গল্প করতে করতে সময় নিয়ে খাওয়া যাবে। মানুষের মাংস দ্রুত খেলে নাকি স্বাদ পাওয়া যায় না। মুখের ভেতর অনেকক্ষণ রেখে গিলতে হয়। প্রতি দশ সেকেন্ড পর একবার করে চিবোতে হবে। এরপর চোখ বন্ধ করলে মানুষের শরীরের একটা মিষ্টি গন্ধ জিহ্বার চারপাশে মেখে যাবে। এটাও ইমরোজের বলা।
আমাদের সামনে মেন্যু নিয়ে আসে অল্পবয়সী এক ওয়েটার।
স্যার কি অর্ডার করবেন? ছেলেটি মেন্যুটা হাতে রেখেই জানতে চায়।
মানুষের মাংসের কি কি রেসিপি আছে তোমাদের? হারুন জানতে চায়।
দুপুরে ফ্রাই, রেজালা, ঝোল, বটি—এগুলো আছে। একটু সময় দিলে স্পেশাল খিচুড়ি ও বিরানি হবে। মাথার মাংস ও হাড়ের নেহারি খেতে চাইলে সকালে আসতে হবে। তেহারি ও কাচ্চি পাবেন রাতে। ছেলেটি ঝটপট তিনবেলার মেন্যুই জানিয়ে দেয়।
এখানকার স্পেশাল কোনটা? আমি জিজ্ঞাসা করি।
দুপুরের মেন্যুতে ফ্রাই অথবা ভুনা। তবে আজ রেজালাও ভালো হবে। শিশুর মাংস এসেছে। হাড়গুলো চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারবেন। মুখে একদম বাধবে না। পাহাড়ি শিশু, ভেজাল খাবার খাওয়া না, তাই মানুষের অর্জিনাল টেস্টটা পাবেন। তবে চর্বিওয়ালা গোশত পছন্দ করলে মোটাগোটা মেয়েমানুষের বুকের ও রানের মাংস আছে। ঝোল রান্না। এটাও নিতে পারেন।
বয়স কেমন? হারুণ বলে।
আমার?
মোটাগোটা মেয়েটার কথা বললে? বুড়ো নাতো?
একদম না। ত্রিশ বছরের বেশি হবে না। খুব মোটা না, নাদুসনুদুস। যেমন ফর্সা, তেমন গড়ন। সাউথের নায়িকাদের মতো। রানে অনেক মাংস ছিল। কা*টার সময় আমি দেখার লোভ সামলাতে পারিনি। এরকম জিনিস তো খুব একটা পাওয়া যায় না। নাভির নিচে বড়ো একটা তিল। নাভির নিচে তিল থাকা সৌভাগ্যের প্রতীক। দেবো স্যার?
শুনে তো পানি চলে এলো, মুখে। সঙ্গে ফ্রাই আর বাটার নান। হারুন ওরটা বলে।
আমার জন্য ঝোল মাংস। সাথে কুচিকুচি করে পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচ। সৌভাগ্যের কথা শুনে মনে হলো খাওয়া উচিত। গত তিন মাসে দুবার চাকরি গেলো। নিলার সঙ্গেও সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। তাছাড়া, নারীশরীরের রানের মাংস শুনে মনে হলো স্বাদের হবে। না হলে একটা রেজালা নিয়ে নেব। সঙ্গে পরোটা। অল্প তেলে ভাজা। আমি বলি।
ছেলেটি অর্ডার নিয়ে চলে যায়।
মানুষের মাংসের আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দাম কিছুটা কমেছে। ফি*লিস্তিন থেকে আসছে। সবই যুদ্ধাহত। দাম বেশি বলে সব হোটেলে রাখে না। ফিলিস্তিনের মানুষ সৌদি আর আমেরিকাতে বেশি যায়। ইস*রায়েল ফিলি*স্তিনি শিশুদের মাংস থেকে এক ধরনের আচার তৈরি করে বাজারে ছেড়েছে, এত দাম যে কারো একার পক্ষে কিনে খাওয়া সম্ভব না। বিশ্বসংঘ থেকে শুরু করে বড় বড় এনজিওর মিটিংয়ে নাকি পরিবেশন করা হয়। আরবের শেখরাও এর বড়ো ক্রেতা। শুনেছি ওদিকে ইয়েমেনে দু*র্ভিক্ষের কারণে বাবা-মায়েরা শিশুদের বিক্রি করে দিচ্ছে। বেশিরভাগই হাব্বিসার, এই কারণে চাহিদা কম। চীন কিনে নিয়ে প্যাকেটজাত করে কম দামে বাজারে দিচ্ছে। আমাদের এখানে সস্তা বলতে মানুষের মাংসের শুটকি। মিয়ানমার রো*হিঙ্গা বৃদ্ধদের শুকিয়ে ইউরোপে রপ্তানি করছে। চোরাপথে এখানে আসে বলে দাম খুব কম। কম হলেও চাহিদা নেই। মানুষের শুটকিতে নাকি ঝাঁজ থাকে না। এটাও ইমরোজ বলেছে। বাংলাদেশে অবশ্য দেশি মানুষের মাংসের চাহিদা বেশি। দেশি মুরগির মতো দেশি মানুষের মাংসের স্বাদও নাকি জ্বিভে লেগে থাকে। কিন্তু আমদানিতে মুনাফা বেশি বলে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের চাপে দেশি মাংস রপ্তানিতে উদ্যোগ নিতে পারছে না সরকার। রপ্তানি করতে পারলে গার্মেন্টেস-এর পর সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক আয় হতো মানুষের মাংসে। আজকাল আবার দেশি বলে অনেক হোটেলে রোহি*ঙ্গা চালিয়ে দিচ্ছে। এটা মনে করেই হারুন বোধহয় ম্যানেজারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি উঠে আসেন আমাদের টেবিলে।
আপনাদের এখানে সব দেশি তো? ভেজাল নেই তো? হারুন জানতে চায়।
নিশ্চিন্তে খেতে পারেন। তারপরও সন্দেহ থাকলে কিচেনের পেছনের স্টোরে কা*টা মাথা আছে, দেখে আসতে পারেন। ফ্রেশ মাথা। আপনাদের যাতে দেখাতে পারি, এই কারণে মাথাগুলো আমরা সঙ্গে সঙ্গে চুরিয়ে ফেলি না। মানুষের মাংস নিয়ে আমরা কোনো ভগিজগি করি না। আমাদের মন্ত্রী মহোদয় এ ব্যাপারে খুব স্টিক্ট।
কোনো কোনো হোটেলে শুনেছি যাদের মাংস রান্না হয়েছে তাদের ছবি রাখা হয়। মানুষ দেখে অর্ডার করতে পারে? আমি শোনা কথার সত্যতা কতখানি জানতে চাই।
ঠিকই শুনেছেন। আমরাই এটা শুরু করেছিলাম। পরে বন্ধ করে ফেলতে হয়েছে।
কেন? ভালো সিস্টেম তো। যার মাংস খাচ্ছি তার চেহারাটা দেখে নিলাম। বন্ধ করলেন কেন?
একবার খুব ঝামেলা হয়েছিল। তারপর থেকে বন্ধ।
কী রকম? জানতে পারি?
এক কাস্টমার ক্যাটালগ দেখতে চাইলেন। আমরা দিলাম। সাধারণত কেউ না চাইলে আমরা দিতাম না। কেউ কেউ আছে পুরাতন সেন্টিমেন্টের, ছবি দেখলে খেতে পারেন না। আবেগ চলে আসে। তো লোকটি ক্যাটালগ দেখে চিৎকার শুরু করে দিলেন। ওখানে নাকি তার মেয়ের ছবি আছে। পরে আমাদের নামে মামলা করে দেয়। তার ধারণা আমরা মেয়েটিকে তুলে এনে জ*বাই করেছি মাংসের জন্য।
তারপর? আপনারা সেটাও করেন নাকি?
মেয়েটি নাকি থার্ড*জেন্ডার ছিল, ওই রূপান্তর*কামী নাকি কি যেন বলে। রাতে কারা যেন খু*ন করে দালালদের কাছে বিক্রি করেছে। দালাল দিয়েছে আমাদের। আসল রহস্য উন্মোচন হয়ে গেলে আমাদের আর সমস্যা হয়নি। রূপান্তরকামী শুনে পুলিশ আর কেইস নেয়নি। এরপর থেকে আমরা আর ছবি দেখাই না। আমাদের একটা সুনাম আছে, মানুষ বিশ্বাস থেকে আসে। একবার যে আসে, পরেরবার তাকে আসতে হয়।
কেন? কি এমন বিশেষত্ত্ব আপনাদের?
আমরা বাজার থেকে মরা মানুষ কিনি না। যেমন ধরুন গতকাল দেশে পনেরজন খু*ন হয়েছে, সড়ক দুর্ঘনায় মৃ*ত্যু হয়েছে বিশজনের মতো, ধর্ষ*ণের পর তিনজন নারী ও একজন ছেলেশিশুকে মে*রে ফেলা হয়েছে। হিন্দুমহল্লায় পুড়ে ম*রেছে চারজন। গাছের সঙ্গে বেঁধে পি*টিয়ে মা*রা হয়েছে এক শিশুকে। চোর ও ছেলেধরা সন্দেহে গণ*ধোলাইয়ে মা*রা গেছে দুজন। ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ে মা*রা গেছে চারজন। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ম্যাচ নিয়ে মরে*ছে দুজন। আমরা একটাও কিনিনি। কম দাম যেখানে দেখবেন, ওরা কেনে। আমাদের মাংস ফ্রেশ।
তার মানে আপনারা তুলে এনে জ*বাই করান? নাকি তাজা মানুষ কিনতে পাওয়া যায়? হারুন প্রশ্ন করে।
তুলে আনার মতো নোংরা কাজ আমরা করি না। আর কিনতে পাওয়া গেলেও সেগুলো অধিকাংশ কেমিক্যাল দেওয়া। জী*বন্ত হলেও ভেজাল। আমাদের নিজস্ব ফার্ম আছে। পথশিশুদের আমরা অল্প দামে কিনে নিই ওদের বাবা-মা অথবা এলাকাভিত্তিক নেতাদের কাছ থেকে। দেখেন-না ফুটপাত কেমন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে! আরামে হাঁটতে পারছেন। কিনে ওদের যত্ন করে পালা হয়। অনেক অবিবাহিত মা জারজ সন্তানদের আমাদের কাছে বিক্রি করে যায়। ভালো দাম পায় বলে আজকাল আর কেউ গর্ভ*পাত ঘটায় না। এই কারণে দেখবেন নবজাতক মৃত্যু*হারের সূচকে আমরা বিশ্বে ভালো অবস্থানে আছি। ম্যানেজার বলে।
বাহ! খুব ভালো। নবজাতক কিংবা ভ্রুণ হ*ত্যার ঘটনা এতো বেড়ে যাচ্ছিল যে সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। একটা ভালো উপায় বের হয়েছে তাহলে। আমি বলি।
আমার মনে হয় প্রসূতি মায়েদের জন্যও ভালো হয়েছে। দেহ*ব্যবসার চেয়ে এই ব্যবসাটা ভালো। পথের মেয়েরা সম্মানের সাথে জীবনধারন করতে পারবে। হারুন বলে।
আয়ও বেশি হয়। ম্যানেজার যোগ করে।
এত দাম দিয়ে রোজ খায় কারা? আমি জানতে চাই।
এলিট ভদ্রলোক, শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। বিশেষ বিশেষ জায়গা থেকে অর্ডার আসে। সৌখিন মধ্যবিত্তরাও আসে, জন্মদিনে কিংবা চাকরির প্রমোশন হলে। কেউ কেউ বসকে খুশি করতে পার্সেল করে। আগে এসকর্ট পাঠাতো, এখন মাংসও পাঠায়।
ম্যানেজার সানন্দে আমাদের প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান। বিরক্ত হচ্ছেন বলে মনে হয় না। এই কারণে আমরা আরও কিছুক্ষণ কথা চালিয়ে যেতে পারি। এর মধ্যে অর্ডার নেওয়া ছেলেটা টেবিলে স্যুপ রেখে যায়।
আমরা তো স্যুপ অর্ডার করিনি? আমি বলি।
এটা কম্প্লিমেন্টরি। ফিঙ্গার স্যুপ। খান, ভুলতে পারবেন না।
শুনেই আমার জিভে জল চলে আসে। এমনিতেই অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা ক্ষুধার্ত। আমি স্যুপের একটা বাটি নিজের দিকে টেনে নিই। পাতলা র*ক্তের রঙ, চামচ দিয়ে নাড়তেই চিংড়ির মতো কুচি কুচি করে কাটা আঙুল ভেসে ওঠে। একটা তুলে মুখে দিই। অমৃত। ভেতরের হাড়টা দাঁতের নিচে পড়ে মটমট করে। চিংড়ির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি স্বাদ। বাচ্চার আঙুল নাকি? আমি জিজ্ঞাসা করি।
আজ একটা পার্টির অর্ডারে দুটো পথশিশু জ*বাই হয়েছে। এই শহর থেকে দুজন অনাগত ভিক্ষুক অথবা পকেটমার কমে গেল। ম্যানেজার বলে।
দারুণ। এই ব্যবসাটা দশ বছর আগে চালু হলে আমার আইফোনটা হারাতে হত না। ওতো দাম দিয়ে কিনে ব্যবহারই করতে পারলাম না। শালার পকেটমার! হারুন শুনে খুশি হয়ে বলে।
বিষয়টা ভালো। জনসংখ্যাও কমছে। অপরাধীর পাশাপাশি আগামীতে আর বেকার থাকবে না। চাকরির বয়স বাড়ানো নিয়ে সরকারের চাপ থাকবে না। আমি বলি।
তবে চাহিদা যেহারে বাড়ছে তাতে সংকট তৈরি হতে পারে। হারুন বলে।
ধূর, গরীব মানুষের অভাব আছে নাকি! শালার যু*দ্ধ লেগেই আছে কোথাও না কোথাও। খু*ন-খারাবি গু*ম-অ*পহরণ কমছে না, বাড়ছে। এত তাড়াতাড়ি সংকট হবে না। আমি জবাব দিই।
চাহিদার কথা মাথায় রেখে আরও ফার্ম তৈরি হচ্ছে। শহরে যারা পথে পথে কুকুরের মতো পড়ে থাকে, সন্তান হলে জানে না পরদিন পাশে পাবে কিনা, কিংবা ঝামেলা এড়াতে নিজেরাই ফেলে দেয় কোনো ডাস্টবিনে, অথবা মাদক খাইয়ে ফুটপাতে ফেলে রেখে ভিক্ষা করে, তাদের আমরা ফার্মে নিচ্ছি। ওখানে ওরা আরামে থাকবে খাবে আর গরু-ছাগলের মতো জন্ম দেবে। সুস্থ্য সবল বাচ্চা নিশ্চিত করতে আমরা ভালো নিউট্রিশন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। ম্যানেজার বলে।
এইটা ভালো হয়েছে। এতদিনে এই কীটপতঙ্গের মতো মানুষগুলো সমাজের কাজে লাগছে। চোর-বাটপারি-মাদক চোরাচালান এসব বন্ধ হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। সমাজে এবার সত্যিকারের শান্তি ফিরে আসবে। মানুষের ভেতর নীতিনৈতিকতার বিষয়টি তো উঠেই যাচ্ছিল। হারুন খুশি হয়ে বলে।
ম্যানেজার বিজ্ঞের মতো সম্মতি জানিয়ে উঠে যান তার আসনের দিকে।
আমরা স্যুপ শেষ করে অপেক্ষা করি।
বিশ্বের নব্বইভাগ মানুষ পশুর মতো খেটে মরছে, আর দশ ভাগ মানুষ কেমন ভোগ করছে দেখেছিস? সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র সব ব্যর্থ। হাজার বছরেও পৃথিবীর কোথাও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হল না। মানুষ একটা মহান শব্দ। ভাস্কর চৌধুরীর কবিতাটা মনে আছে: “মানুষকে এত ক্ষুদ্রার্থে নেবেন না, / মানুষ এত বড় যে,/ আপনি যদি ‘মানুষ’ শব্দটি/ একবার উচ্চারণ করেন/ যদি অন্তর থেকে করেন উচ্চারণ/ যদি বোঝেন এবং উচ্চারণ করেন ‘মানুষ’ / তো আপনি কাঁদবেন।” আমি বলি।
ক্ষমতার রাজনীতিকে আমরা দোষ দিই, আসল অপরাধী হলো শিল্পপতিরা। না, অপরাধী আমরা, শ্যালা মধ্যবিত্তরা। হারুন বলে। ছাত্ররাজনীতি করত, সুযোগ পেলেই রাজনীতির কথা শুরু করে দেয়। আমি শিল্পীমানুষ, ওর কোথায় তেমন আগ্রহ খুঁজে পাই না। সমাজ পরিবর্তন করা এখন শিল্পীদের কাজ না। শিল্পবিমুখ সমাজে সে সুযোগ আর নেই। এ ধরনের কথা আমি হারুনকে বলি। ও আমার সঙ্গে একমত হতে পারে না। গণসাহিত্যের কথা বলে। আমরা যখন বৃহত্তর সমাজ ও বঞ্চিত মানুষের অবস্থার পরিবর্তন নিয়ে সিরিয়াস আলোচনার ভেতরে চলে যাই, তখনই আমাদের টেবিলে মানুষের মাংস সার্ভ করা হয়।
স্যার একটু আস্তে কথা বলবেন, পাশের টেবিলে সমস্যা হচ্ছে। ওয়েটার এসে বলে। তাকিয়ে দেখি আমাদের সামনের টেবিলে কয়েকজন দেশি বিদেশি মিলে মিটিং সারছে। চোখে পড়ে এক ভদ্রলোকের হাতে একটা ফাইলে লেখা, হিউম্যান রাইটস ইন স্লামস।
মিট হিউম্যান মিট রেস্তোরাঁয় এভাবেই নাকি রোজ রোজ সমাজ বদলের তর্কে বসে বিত্তবান মানুষেরা, প্রান্তিক মানুষের অধিকার নিয়ে মিটিং করে দেশি বিদেশি সংগঠনগুলো।
খেতে খেতে হঠাৎ নিলার কথা জিজ্ঞাসা করে হারুন। নিলা আমার স্ত্রী। তিন দিন হলো রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। হোটসঅ্যাপে এক সহকর্মী নারীর সঙ্গে আলাপটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। ডিলিট করার আগেই নিলা দেখে ফেলে। হারুনকে বলি।
কোথায় গেছে। খালাম্বার কাছে?
না।
তাহলে?
মোটামুটি পরিচিত জায়গাগুলোতে খোঁজ দিয়েছি, যায়নি।
এখন কি করবি? তিন দিন হয়ে গেলো বলছিস!
চলে আসবে। এটা তো আর নতুন না। দিন চারেক যাক, ফিরে আসবে। একবার তো দশদিন পর ফিরেছিল, মনে নেই? তুই-তো আনলি। হারুনকে বলি।
হ্যাঁ, সেবার তো ভাইয়ের বাসায় উঠেছিল। বলে হারুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, একবার মাথাটা দেখবি নাকি?
মানে?
না, মানে, খেলাম যখন, কাকে খেলাম একটু দেখে যাবো না!
বাল দেখবে! কখনো কোনো হোটেলে গিয়ে গরুর মাংস খেয়ে বলেছিল, গরুটা দেখবো? আমি বলি।
ধ্যাত! গরু আর মানুষ এক হলো?
একই। আগুনে ঝ*লসে গেলে সব এক। আমার এই কথার পর হারুন আর কথা বাড়ায় না। আমরা খাওয়া শেষ করে উঠি। টেবিল খালি করে দিতে হবে।
বিল দেওয়ার সময় ম্যানেজার হাসতে হাসতে আমাদের বলে, আবার আসবেন স্যার! আমাদের মানুষের মাংসে কোনো ভেজাল নেই।
রাস্তায় নেমে রিকশা ডাকি। হারুন উবার ডেকেছে।
মাথাটা একবার দেখলে হতো না? হ্যান্ডশেক করার সময় হারুন বলে।
আরে না। কার কী মাথা, দেখে কি হবে!
ছেলেটি কি বলল শুনিসনি? হারুন কিছু একটা বলতে চায়। আমি আর কথা না বাড়িয়ে রিকশাই উঠে বসি। খানিকটা এসে বাক নিতেই মাথাটা চক্কর কেটে ওঠে। নিলার তিলের বিষয়টি হারুন জানলো কিভাবে?
----------------------------------
বই: মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ
প্রথম প্রকাশ ২০২১, ৭ম মুদ্রণ ২০২৪, পাঞ্জেরী পাবলিকেশনস
কলকাতা সংস্করণ, বুক ফার্ম ২০২৪
ইংরেজি সংস্করণ: অ্যান্টোনিম, ভারত, ২০২৩
-----------------
গল্পটি ইংরেজি, হিন্দি, গুজরাটি, নেপালি ও ইতালি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
নাট্যরূপ মঞ্চস্থ হচ্ছে শান্তিনিকেতনে।










এখানে সমাজকে এমনভাবে আয়নায় দাঁড় করানো হয়েছে যে সে নিজেকেই চিনতে পারবে না—একটু জাদুবাস্তবতা, খানিকটা ব্যঙ্গ, আর মুঠো মুঠো প্রতীকবাদের চমৎকার রাঁধুনি-ঘটকালি। পাঠকের মগজে ঢোকার ব্যবস্থা এমন যে, গল্প পড়ার পর মাথার মধ্যে একটা ছোটখাটো বিদ্রোহ শুরু হবে—"এতদিন যা সত্যি ভেবেছিলাম, সেটা কি সত্যিই সত্যি?"
অসঙ্গতি দেখা এই পৃথিবীতে এর চাইতে ভালো গল্প কি হয়!
লেখককে অকৃত্রিম ভালোবাসা। ❤️💚🩵